স্টাফ রিপোর্টার: জহির শাহ্ | ✪ ব্রাহ্মণবাড়িয়া |
একটি ঘটনার পেছনে থাকে অনেক না-বলা ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস যদি গড়ে ওঠে জনস্বার্থ, শাসন ও গায়েব জনপ্রতিনিধিত্বের প্রেক্ষাপটে—তবে তা আর কেবল নিউজ নয়, হয়ে ওঠে সময়ের স্বাক্ষর, এক টান টান দলিল।
অপসারণের ঘোষণা: এক অফিস আদেশ, এক পরাক্রমের অবসান
সরাইল উপজেলার দুই ইউনিয়নের দুই চেয়ারম্যান—দুজনই এক সময়ের আওয়ামী ঘরানার প্রভাবশালী নেতা। আজ, তাঁরা আর নেই অফিস কক্ষে, নেই সভায়, নেই জনগণের চোখে। এই অপসারণ এসেছে নির্বাচনী ব্যর্থতা বা জনরোষের কারণে নয়—বরং তাদের নিস্তব্ধতা ও নিখোঁজত্বের প্রতিদানস্বরূপ।
যাঁরা অপসারিত:
আছমা বেগম, শাহজাদাপুর ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
খাইরুল হুদা চৌধুরী, শাহবাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট—যেদিন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতা হারায়—সেদিন থেকেই এই দুই জনপ্রতিনিধি হারিয়ে যান জনচক্ষু থেকে। কারও মতে তাঁরা “আত্মগোপনে”, আবার কারও বিশ্বাস—“উঁদের ওপর মামলা ঝুলছে, ঘরে ফিরলেই হাতকড়া।”
সাড়ে ১০ মাসের শূন্যতা: নেতৃত্ব না থাকলে শুধু দেয়াল থাকে
উপজেলা প্রশাসনের ফাইলে দেখা যাচ্ছে—গত দশ মাসে তাঁরা অংশ নেননি একটি সভাতেও। অফিসে তাঁদের উপস্থিতি ছিল গল্পের মতো, নাম ছিল তালিকায়—কিন্তু কোনো সই, কোনো নির্দেশনা, কোনো প্রান্তিক দরিদ্রের কান্না শুনে নেওয়া—কিছুই না। ২৩ জুন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম স্বাক্ষরিত আদেশে তাঁদের দায়িত্ব স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শাহজাদাপুরে দায়িত্ব পান প্যানেল চেয়ারম্যান অমরেশ সরকার শাহবাজপুরে দায়িত্ব দেওয়া হয় উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মুমিন হোসেন ভূঁইয়াকে।
গোপন মামলা, ওপেন বাস্তবতা: রাজনীতি এখন ছায়াপথে দুই চেয়ারম্যানই ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার পতনের আগ পর্যন্ত, ইউনিয়নের সব “দেখা না গেলেও থাকা” নেতার প্রতিচ্ছবি। আজ তাঁরা নেই, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে রয়েছে “দেখা যায় না এমন” একাধিক হত্যা ও দাঙ্গা মামলা।
স্থানীয়রা বলছে, একপক্ষের অভিযোগ:
> “এরা দখলের রাজা। প্রতিপক্ষ মারতেই উঠে পড়ে লেগেছিল।” অন্য পক্ষের ভাষ্য: “সব মিথ্যা। আওয়ামী লীগ হারতেই প্রতিশোধ শুরু হয়েছে।”
> এক সত্য, দুই ব্যাখ্যা। কিন্তু জনগণের সামনে প্রশ্ন একটাই: নেতৃত্ব কী ছায়ার মতো গায়েব হতে পারে?
জনগণের প্রতিক্রিয়া: মুখ না থাকলে নাম দিয়ে কী হবে?
চা দোকানি, শাহজাদাপুর বাজার: > “উনারা ছিলেন কি না, জানতাম না। এখন অন্তত অফিস খোলা থাকে, একজন দায়িত্বে আছে।”
নারী উন্নয়ন ফোরামের সদস্য: > “নারী ক্ষমতায়ন কেবল পদ দিয়ে হয় না। দায়িত্বহীন নারী নেতৃত্ব আসলে নারীদের অপমান।”
স্থানীয় তরুণ, কলেজপড়ুয়া: > “ভালো হয়েছে। কিন্তু ভয় পাই—এই ফাঁকা জায়গায় আবার নতুন ‘বাহুপ্রধান’ আসবে না তো?”—
প্রশাসনের ভাষ্য: শৃঙ্খলার স্বার্থেই পদক্ষেপ
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোশারফ হোসাইন বলেন: “জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্বে না থাকলে জনগণের সেবা থমকে যায়। বারবার অনুপস্থিত থাকায় প্রশাসন নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে।” জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান: > “এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক নয়, এটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও পরিষেবা বজায় রাখার অংশ।”
ভবিষ্যতের প্রশ্ন: নেতৃত্ব ফিরবে—তবে কেমন করে?
এখন ইউনিয়নবাসীর চোখ নতুন নেতৃত্বের দিকে। অনেকে আশা করছে—এই অপসারণ যেন এক পুনর্জাগরণ হয়। কেউ ভয় পাচ্ছে—পুরোনো প্রভাবশালীদের যায়গা নিতে হয়তো আসছে নতুন কৌশলী দখলদার। তবে জনগণের মনের কথা একটাই— “নেতা চাই না, চাই নেতৃত্ব।”