ইতিহাসে অনেক রহস্যঘেরা ঘটনার মধ্যে অন্যতম ইংল্যান্ডের সাফোক কাউন্টির পোলস্টিড মাডার বা “রেড বার্ন হত্যাকাণ্ড”। সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত উইলিয়াম কর্ডারের চামড়া দিয়ে বাঁধানো একটি বইয়ের সন্ধান সম্প্রতি পাওয়া গেছে সাফোকের মোইসেস হল মিউজিয়ামে। অবাক করা ব্যাপার হলো, এটাই প্রথম নয়—মিউজিয়ামের সংগ্রহে ইতিমধ্যেই কর্ডারের চামড়া দিয়ে বাঁধানো আরও একটি বই ছিল। নতুন করে পাওয়া এই দ্বিতীয় বইটি যুগপৎই বিস্ময়কর এবং বিতর্কিত।
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮২৭ সালে। সাফোকের পোলস্টিড গ্রামের রেড বার্ন (লাল খামারঘর) ছিল এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মঞ্চ। সেখানে নিজের প্রেমিকা মারিয়া মার্টেনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেন উইলিয়াম কর্ডার। হত্যার পর প্রেমিকার দেহ খড়ের গাদায় পুঁতে রেখে কর্ডার পালিয়ে যান। তার পরিকল্পনা ছিল প্রেমিকাকে নিয়ে অন্যত্র গিয়ে গোপনে বিয়ে করার নাটক সাজানো।
কিন্তু রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। ১৮২৮ সালের আগস্টে কর্ডার গ্রেপ্তার হন এবং আদালতে বিচারের মুখোমুখি হন। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তার মৃতদেহ শল্যচিকিৎসা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয় বই। সেই বইয়ে কর্ডারের বিচার সংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষিত ছিল।
প্রায় দুই শতাব্দী পরে মোইসেস হল মিউজিয়ামের কর্মীরা তাদের সংগ্রহের পুরোনো ক্যাটালগ ঘাঁটতে গিয়ে এই দ্বিতীয় বইটির সন্ধান পান। বইটি এতদিন ছিল জাদুঘরের কার্যালয়ের একটি সাধারণ বইয়ের তাকেই, অন্য বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল।
হেরিটেজ কর্মকর্তা ড্যান ক্লার্ক বলেন,
“বইটি আমরা নতুন করে আবিষ্কার করেছি। এটি কয়েক দশক ধরে কারও নজরে আসেনি।”
প্রথম বইয়ের পুরো কাভারটাই মানুষের চামড়ায় মোড়ানো হলেও, সদ্য আবিষ্কৃত দ্বিতীয় বইটির কেবল বাঁধাইয়ের অংশে মানুষের চামড়া ব্যবহৃত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দ্বিতীয় বইটি কর্ডারের শরীর ব্যবচ্ছেদ করা সার্জনের পরিবার থেকেই সংগ্রহে এসেছিল এবং পরবর্তীতে দান করা হয় জাদুঘরে।
মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাইয়ের প্রচলনকে বলা হয় Anthropodermic Bibliopegy। এই কাজটি মধ্যযুগ বা আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়গুলোর একটি। বিশেষত, অপরাধীদের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে তাদের স্মৃতিচিহ্ন বা বিচার সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের জন্য এমনটা করা হতো।
এই আবিষ্কার নিয়ে বিতর্কও শুরু হয়েছে। জনপ্রিয় ‘হরিবল হিস্টোরিজ’ বইয়ের লেখক টেরি ডেয়ারি বলেন,
“এটি একটি বীভৎস কাজ। আমি হলে এই বইগুলো পুড়িয়ে ফেলতাম। কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার থেকেও জঘন্য কাজ হচ্ছে মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করে মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাই করা।”
তবে হেরিটেজ অফিসার ড্যান ক্লার্ক বলছেন,
“আমরা দেশের প্রায় প্রতিটি জাদুঘরেই মানুষের দেহাবশেষ প্রদর্শন করতে দেখি। এগুলো ঐতিহাসিক দলিল, এগুলো মুছে ফেলা উচিত নয়।”
উইলিয়াম কর্ডারের এই হত্যাকাণ্ড জর্জিয়ান ব্রিটেনকে স্তম্ভিত করেছিল। এরপর থেকে বই, নাটক, সিনেমা ও লোকগীতিতে বারবার ফিরে এসেছে এই গল্প। বিশেষ করে ‘দ্য মার্ডার ইন দ্য রেড বার্ন’ নামে বেশ কিছু নাট্যরূপ রয়েছে। বলা হয়, ইংরেজ লোকসংগীতের ইতিহাসেও এটি সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত হত্যাকাণ্ড-ভিত্তিক গল্পগুলোর একটি।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যে, ঐতিহাসিক সত্য যত ভয়াবহই হোক, সেগুলো সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয়। কর্ডারের চামড়া দিয়ে বাঁধানো বইগুলো শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি নয়, বরং সমাজের অপরাধবোধ, বিচারপ্রক্রিয়া এবং মানুষের নিষ্ঠুরতার ইতিহাসেরও অংশ।
📌 তথ্যসূত্র:
✍️ প্রতিবেদন: কালিকা প্রসাদ টিভি | আন্তর্জাতিক ডেস্ক