বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে গার্মেন্টস সেক্টরের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই শীর্ষে। তৈরি পোশাক শিল্প বা RMG (Ready Made Garments) খাত বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি জোগান দেয়। বর্তমানে দেশের প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ এই খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। শুধু রপ্তানি নয়, এই খাত বাংলাদেশের নারীর আর্থিক স্বাধীনতা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভ।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বৈশ্বিক বাজারে চীন তাদের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে এবং বিকল্প উৎস খুঁজছে অনেক বড় ব্র্যান্ড। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় গন্তব্য হিসেবে উঠে এসেছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে, কারণ এখানকার পোশাক তুলনামূলকভাবে সস্তা, মানসম্মত এবং সময়মতো ডেলিভারি হয়।
তবে শুধু সস্তা শ্রম বা উৎপাদন খরচ নয়, গার্মেন্টস সেক্টর বর্তমানে টেকসই উৎপাদনের দিকেও নজর দিচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি LEED সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশে। এতে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্ববাজারে আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
অন্যদিকে, গার্মেন্টস খাতকে ঘিরে দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রি। ফেব্রিক, অ্যাকসেসরিজ, প্যাকেজিং, ডাইং-প্রিন্টিংসহ বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান সরাসরি গার্মেন্টসের সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর সঙ্গে। শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো, দক্ষতা উন্নয়ন, শ্রমিক অধিকার, পণ্যের বৈচিত্র্যতা এবং কারিগরি উন্নয়ন – এই সবগুলো বিষয়ে নজর না দিলে ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হতে পারে।
সরকার, উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক – এই তিন পক্ষের সমন্বয়ে গার্মেন্টস সেক্টরকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। কারিগরি প্রশিক্ষণ, শ্রমিক বান্ধব পরিবেশ, ইনোভেশন ও নতুন বাজার খুঁজে বের করার মাধ্যমে এই খাতের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল করা যেতে পারে।
সব মিলিয়ে গার্মেন্টস সেক্টর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে, যদি সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়। এই খাত শুধু অর্থনীতিকেই এগিয়ে নিচ্ছে না, বরং গড়ছে লাখো মানুষের জীবনের নতুন স্বপ্ন।