মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে এবার কূটনৈতিক মিশনে যাচ্ছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসতে চলেছেন তিনি। এ তথ্য জানিয়েছেন আরাগচি নিজেই, রাশিয়ার একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে।
আব্বাস আরাগচি জানিয়েছেন, রবিবার (২২ জুন) দিন শেষে তিনি তেহরান থেকে মস্কোর উদ্দেশে যাত্রা করবেন। সফরসূচি অনুযায়ী রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি। মূলত বর্তমান যুদ্ধাবস্থা, বিশেষ করে ইরান-ইসরায়েল বিরোধ ও এর সঙ্গে যুক্ত আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়েই আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাক্ষাৎকারে ইরানের এই শীর্ষ কূটনীতিক বলেন, “আমাদের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে। প্রতিটি বড় ইস্যুতে আমরা পারস্পরিক যোগাযোগ করি এবং আমাদের অবস্থান একসঙ্গে সমন্বয় করি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-রাশিয়া সম্পর্ক এই মুহূর্তে শুধু সামরিক কিংবা বাণিজ্যিক নয়, বরং কৌশলগত জোটে রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে এই জোট আরও দৃঢ় হতে যাচ্ছে।
বৈঠক প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আব্বাস আরাগচি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি বলেন, “আমরা মনে করি এখন আর কোনো সীমারেখা নেই, যেটা যুক্তরাষ্ট্র লঙ্ঘন করেনি। তাদের সর্বশেষ পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের দেশের পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি হামলা চালিয়ে তারা এমন এক সীমা অতিক্রম করেছে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য ভয়ানক হুমকি।”
বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধু ইরান নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক কাঠামোকে পাল্টে দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরানও বসে থাকেনি। রবিবার সকালে প্রায় ২০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান, যার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের অন্তত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে তেল আবিব, হাইফা, ও আরও কয়েকটি সামরিক স্থাপনা।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, “আমরা মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের আকাশে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছি এবং এর কিছু অংশ প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে সরাসরি আঘাত হেনেছে।”
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট জানায়, হামলার সময় তেল আবিবসহ বেশ কয়েকটি শহরে ভারী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ৮৬ জন আহত হয়েছেন।
রাশিয়া এই সংঘাতের শুরু থেকেই প্রকাশ্যে ইরানের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আসছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মস্কো-তেহরান সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। চলতি বছরের শুরুতে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও দুই দেশের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বৈঠকে ইরান চায় রাশিয়ার আরও প্রকাশ্য ও কার্যকর সমর্থন। বিশেষ করে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার অবস্থান ইরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তবে রাশিয়ার সাম্প্রতিক অবস্থান কিছুটা কৌশলী। একদিকে তারা ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চাইছে না। পুতিন প্রশাসন চাইছে— এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলা হলেও, তারা যেন প্রকাশ্যে সরাসরি লড়াইয়ে না জড়িয়ে পড়ে।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মহলে একটাই প্রশ্ন— মধ্যপ্রাচ্যে এই উত্তেজনা কোথায় গিয়ে থামবে? যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করবে? আর ইরান যদি রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ইসরায়েলবিরোধী জোট গড়ে তোলে, তাহলে সেটি হবে এই অঞ্চলের জন্য এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।
সবচেয়ে বড় কথা, পুতিন-আরাগচি বৈঠকের পর রাশিয়া কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে— সেটাই এখন পুরো বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছে।
তাজা খবর, বিশ্ব রাজনীতি ও যুদ্ধ পরিস্থিতির সঠিক আপডেট পেতে আমাদের সঙ্গে থাকুন।