ভূমিকা: একদিকে ভোটের উৎসব, অন্যদিকে নদীর শোকগাথা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যতবার পালাবদল ঘটে, ক্ষমতার হাত বদল হয়, ততবারই নতুন আশাবাদের ঢেউ ওঠে। কিন্তু সেই ঢেউ ছুঁয়ে যেতে পারে না আমাদের মাটির গর্ভের রক্তপ্রবাহ—নদীগুলোকে। কারণ, হয়তো আমরা ভুলে গেছি: নদী বাঁচলে দেশ বাঁচে।
নদী মানে জীবন—তবুও প্রাণহীন এই জলধারা!
স্রোতহীন বুড়িগঙ্গা, দূষণে ধূসর শীতলক্ষ্যা, দখলে বিষণ্ণ কর্ণফুলী—এই ছবিগুলো কি আমাদের চোখে পানি আনে না? আজ বাংলাদেশে নদী যেন শুধুই ভৌগোলিক পরিভাষা। মানচিত্রে নাম আছে, বাস্তবে দখলদারিত্ব আর দূষণের কালো চাদরে ঢাকা। জলপ্রবাহ আজ নিঃশব্দ এক আর্তনাদ।
দল যায়, দল আসে—দখলদার ঠিক থাকে!
নির্বাচনের পর আসে নতুন সরকার, আসে নতুন প্রতিশ্রুতি। কিন্তু নদীর ভাগ্যে আসে না কোনো শুভক্ষণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, “রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা দখলদার গোষ্ঠীই এই সংকটের মূল জড়।” কর্ণফুলীর বুক চিরে গড়ে ওঠা অবৈধ হাটবাজার থেকে শুরু করে মেঘনার জমিতে দাঁড়ানো শিল্প সাম্রাজ্য—প্রতিটি উদাহরণেই মিশে আছে রাজনৈতিক ক্ষমতার গন্ধ।
বিশ্লেষণ: কেন আমরা নদী বাঁচাতে পারছি না?
১. রাজনৈতিক প্রভাব: নদী রক্ষা কমিশনের কার্যক্রমকে রাজনৈতিক শক্তি প্রতিনিয়ত বাঁধা দেয়।
২. প্রশাসনিক দুর্বলতা: কমিশন চাইলে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগে অনীহা, অসহায়ত্ব ও কখনো কখনো চুপিসারে সমঝোতা।
৩. সীমাহীন দূষণ: বর্জ্য, প্লাস্টিক, রাসায়নিক পদার্থে পরিণত হচ্ছে নদী ভাগাড়ে।
৪. বালু ও পাথর চোরাকারবার: অবৈধভাবে উত্তোলন করে নদীর প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে একটি অপরাধ সিন্ডিকেট।
৫. আইনের অপপ্রয়োগ ও ফাঁকফোকর: প্রশাসনিক ব্যক্তিরাই কখনো কখনো দখলের অংশীদার, কখনো নীরব দর্শক।
পরিসংখ্যান—যা হৃদয় বিদীর্ণ করে
নদী দখল: ‘রাজনৈতিক প্রজেক্ট’ না ‘জাতীয় দুর্যোগ’?
যখন সরকারের ভেতরেই কেউ নদী ভরাট করে কারখানা স্থাপন করে, তখন প্রশ্ন জাগে— আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, না ধ্বংসকে উৎসব করছি?
নদী দখল এখন কেবল অপরাধ নয়, এটা এক রীতিমতো “পলিটিক্যাল বিজনেস মডেল”।
চেয়ারম্যান গেলেন, চেয়ার থেকেই গেল অপারগতা
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানরাও যেন নিজেরাই আজ কাহিল! একজন চেয়ারম্যান সরিয়ে দেওয়া হয় “রহস্যজনকভাবে”, আরেকজন ছিলেন নিরব দর্শক, তৃতীয়জন সাহস দেখালেও জেতেননি “ক্ষমতার খেলা”য়। এই বাস্তবতা বলছে—নদী রক্ষার চেয়ারেও বসে থাকা যায়, কাজ করে বাঁচা যায় না।
সমাধান কী? শুধু আহাজারি নয়—প্রয়োজন দৃঢ় পদক্ষেপ
✔ রাজনৈতিক সদিচ্ছা
✔ জিরো টলারেন্স ভিত্তিক আইন প্রয়োগ
✔ দখলদারদের অর্থদণ্ড, শাস্তি, এবং জনসম্মুখে প্রকাশ
✔ নির্বাচনী ইশতেহারে নদী সুরক্ষা বাধ্যতামূলক করা
✔ প্রতিটি জেলায় নদী সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধার সেল গঠন
চূড়ান্ত বার্তা:
নদী কাঁদছে—কিন্তু তার কান্না আমরা শুনছি না। আমরা যদি নদীর কান্নাকে শুধুই “নির্বাচনী উপকরণ” হিসেবে দেখি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে—
নদী বাঁচাবো, না নিঃশেষ করবো?