নিজস্ব প্রতিবেদক:
মানবতা, নিঃস্বার্থতা ও আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার গোরখোদক মনু মিয়া আর নেই। আজ ২৮ জুন ২০২৫, শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৭ বছর।
মনু মিয়া ছিলেন একজন গোরখোদক, তবে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিনা পারিশ্রমিকে তিন হাজারেরও বেশি কবর খুঁড়েছেন তিনি। ‘শেষ ঠিকানার কারিগর’ নামে স্থানীয়ভাবে খ্যাত এই মানুষটি কোনোদিন কারও কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেননি। মানুষের শেষ বিদায়টিকে সহজ ও সম্মানজনক করতে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
দুর্গম হাওরের একমাত্র ভরসা ছিল মনু মিয়া। মানুষ মারা গেলে সংবাদ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন কবর খুঁড়তে। প্রথমে হেঁটে, পরে সাইকেলে, আর এক সময় নিজের ধানিজমি বিক্রি করে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন—শুধু যেন সময়মতো পৌঁছাতে পারেন। সেই ঘোড়া তার কর্মজীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। এলাকাবাসী তাকে চিনত ‘ঘোড়াওয়ালা গোরখোদক’ হিসেবে।
গত মে মাসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালীন দুর্বৃত্তরা তার প্রিয় ঘোড়াটিকে হত্যা করে। এ ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তখন থেকেই তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। জীবনের শেষ সময়টুকু ছিলেন হতাশাগ্রস্ত ও নিঃসঙ্গ।
তিনি জীবনের শেষদিকে পবিত্র হজ পালনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। এলাকাবাসী তার জন্য অর্থ সংগ্রহ শুরু করলেও, হজে যাওয়ার আগে-ই শেষ বিদায় জানালেন এই মহান মানুষটি।
মনু মিয়ার মৃত্যুতে পুরো ইটনা উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
জয়সিদ্ধি ইউপি চেয়ারম্যান মো. বাহাউদ্দিন ঠাকুর বলেন,
“মনু মিয়া ছিলেন আমাদের এলাকার গর্ব। এমন নিঃস্বার্থ মানুষ এখন পাওয়া দুষ্কর।”
স্থানীয় একজন বাসিন্দা জানান,
“মনু ভাই ছিলেন এমন একজন মানুষ, যার প্রতি কোনো মুরুব্বি বা পরিবার ‘না’ বলতে পারতেন না। তাঁর মৃত্যুতে আমরা যেন আমাদের একজন আত্মীয়কে হারালাম।”
আজ বিকেল সাড়ে ৫টায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়—সেই একই জায়গায়, যেখানে তিনি জীবনের প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে হাজারো মানুষকে শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন।
মনু মিয়ার মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবতা, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগ এখনও বিলুপ্ত হয়নি। তিনি ছিলেন সমাজের জন্য একটি জীবন্ত শিক্ষা, একটি আলোকবর্তিকা। তার জীবনযাপন নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দেয়, ভালো কাজ করতে ধন-সম্পদ লাগে না—লাগে শুধু এক টুকরো মনুষ্যত্ব।