লুৎফর সিকদার, গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি
গোপালগঞ্জ জেলা কারাগার দিন দিন মাদকের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। কারাগারের নিরাপত্তার মধ্যে থেকেও নিয়মিত উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা, গাঁজা ও আঠা। সম্প্রতি মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে দুইবার ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রশ্ন উঠছে—কারাগারের ভেতরে কীভাবে এতো সহজে মাদক প্রবেশ করছে? কারা কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে অভিযানে মাদক উদ্ধার করলেও, এর সাথে জড়িত প্রকৃত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
মুক্তি পাওয়া বেশ কয়েকজন কারাবন্দি জানিয়েছেন, জেলের ভেতরে মাদক প্রবেশের প্রধান পথ হচ্ছে কারারক্ষীরা। তাদের সহযোগিতায় বাইরে থেকে ইয়াবা, গাঁজা ও আঠা কারাগারে প্রবেশ করে। এরপর নির্দিষ্ট কয়েদিরা সেগুলো বিক্রি ও সেবন করে থাকে। মাঝে মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তল্লাশি চালিয়ে মাদক উদ্ধার করলেও প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করা যায় না। কারাবন্দিদের কাছ থেকেও কোনো তথ্য বের করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ তারা মুখ খুলতে ভয় পায়।
সাধারণত কারাগারে যদি কোনো বন্দির কাছে মাদক পাওয়া যায়, তবে তাকে অস্থায়ী শাস্তি যেমন—ডান্ডাবেরী বা সেলে রাখা হয়। কিন্তু এতে মূল চক্র ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কারা নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন কিছু কারারক্ষী পোশাকধারী ও সিভিল ড্রেসে অবাধে প্রবেশের অনুমতি পান। এই নিয়মের সুযোগ নিয়ে মাদক প্রবেশের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন অনেকে।
রবিবার (১৭ আগস্ট) জেলা কারাগারের ভেতরে পদ্মা ভবন এক ও দুই নম্বর ওয়ার্ডে তল্লাশি চালিয়ে ৩২ পিস ইয়াবা ও আঠা উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষ। এর আগে ৩ আগস্ট একই ধরনের অভিযানে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল। নিয়মিত এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রশাসনের ভেতরে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেলার তানিয়া জামান মাদক উদ্ধারের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তবে মাদক উদ্ধার হওয়ার পর একজন হাজতিকে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও সেলের ভেতরে রাখার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে কারা সুপার শওকত হোসেন মিয়া জানিয়েছেন, কারাগারে মাদক রাখা বা সেবনের দায়ে বন্দিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে জেলারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি।
এ অবস্থায় কারাগারের ভেতরে মাদক নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন—যেখানে রাষ্ট্রের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী, সেখানে যদি মাদক প্রবেশ করতে পারে, তবে দেশের অন্য জায়গায় মাদক নিয়ন্ত্রণ কতটা কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়।
আরও পড়ুন: গোপালগঞ্জে র্যালি-অনুদান-সনদ: যুব দিবসের দিনটি ছিল উদ্বুদ্ধকর
মাদক কারবারিরা দীর্ঘদিন ধরেই কারাগারকে নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলের ভেতরে তাদের চক্র সক্রিয় থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর ফলে বন্দিদের মধ্যে মাদকাসক্তি বেড়ে যাচ্ছে এবং পরিবেশও দিন দিন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কেবল তল্লাশি চালিয়ে মাদক উদ্ধার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এর পেছনের মূল উৎস ও চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে যেসব কারারক্ষী বা ভেতরের লোকজন জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, গোপালগঞ্জ জেলা কারাগার এখন যেন আরেকটি “মাদক হাব”-এ রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের খবর প্রকাশিত হলেও এর বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে কড়া নজরদারি ও স্বচ্ছ তদন্ত না হলে কারাগারের ভেতরে মাদক প্রবেশ ঠেকানো সম্ভব নয়।
এদিকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া কয়েকজন বন্দি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, কারাগারের ভেতরে নির্দিষ্ট কিছু প্রভাবশালী বন্দি ও রক্ষীদের আশ্রয়ে এই ব্যবসা চলে। তারা চান না এসব তথ্য বাইরে আসুক, কারণ এতে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ফলে বন্দিরা ভয়ে কারও নাম বলতে চায় না।
গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারের ভেতরে মাদক উদ্ধারের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে ইয়াবা, গাঁজা ও আঠা উদ্ধার হচ্ছে, তাতে এটি এখন বড় সংকটে রূপ নিচ্ছে। মাদক শুধু আইনশৃঙ্খলার জন্যই নয়, বন্দিদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভয়াবহ হুমকি। সঠিক নজরদারি না থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নিউজের তথ্যসূত্র: এস বাংলা টিভি