এক কিডনির গ্রাম”: দারিদ্র্য আর প্রতারণার বলি জয়পুরহাটের শত মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক: ৫ ই জুলাই ২০২৫
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রাম আজ ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। চরম দারিদ্র্য, ঋণের বেড়াজাল, এবং দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে গ্রামের বহু মানুষ ভারতে গিয়ে নিজেদের কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এক সময়ের শান্তিপূর্ণ এই গ্রামটি আজ অসংখ্য অপারেশনের ক্ষতচিহ্নে ব্যথিত, যেখানে প্রতিটি বাড়িতে যেন লুকিয়ে আছে একটি করে ট্র্যাজেডি।
৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন ২০২৪ সালে ভারতে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে। সেই অর্থ দিয়ে সন্তানদের জন্য ঘর তৈরি করার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন শুধুই ভগ্নাংশ। অপারেশনের পর চিকিৎসা কিংবা ওষুধ না পাওয়ায় এখন তিনি অসহ্য ব্যথা নিয়ে প্রতিদিন কাজ করছেন একটি হিমাগারে। ভারত যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র তৈরি করে দিয়েছিল দালাল চক্র। নিজের পাসপোর্ট ব্যবহার করলেও, হাসপাতালের কাগজে তিনি হয়ে যান রোগীর আত্মীয়—ভুয়া জন্মসনদ, নকল আইডি ও নোটারি দিয়ে সাজানো হয় পুরো প্রক্রিয়া।
ভারতীয় আইনে কিডনি প্রতিস্থাপন শুধুমাত্র নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বৈধ। তবে দালালরা নিয়ম ফাঁকি দিয়ে তৈরি করে ভুয়া আত্মীয়তা ও জাল নথিপত্র। অনেক ক্ষেত্রেই কিডনি বিক্রেতারা অপারেশনের পর কোনো কাগজপত্র বা চিকিৎসা সহায়তা পান না।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথ-এর এক গবেষণা বলছে, কালাই উপজেলায় প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। অধিকাংশই ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষ, যারা দারিদ্র্য, ঋণ কিংবা মাদক থেকে মুক্তি পেতে এই পথ বেছে নেন। অথচ অপারেশনের পর প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও তারা পান না।
কেউ কেউ প্রতারিত হয়ে পরে চক্রের অংশও হয়ে যান। যেমন সাজল (ছদ্মনাম), যিনি ২০২২ সালে দিল্লিতে কিডনি বিক্রি করেন। কথা ছিল ১০ লাখ, হাতে পান সাড়ে তিন লাখ টাকা। পরে আরও কিডনি বিক্রেতা জোগাড় করতে থাকেন, কিন্তু টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে চক্র ত্যাগ করেন। এখন তিনি ঢাকায় রাইড শেয়ারিং গাড়ি চালান, অতীতের স্মৃতি আজও তাড়া করে তাকে।
এই ট্রান্সপ্লান্ট চক্রে দালালদের পাশাপাশি জড়িত থাকে হাসপাতাল, জাল কাগজপত্র তৈরির কিছু কর্মকর্তা, এমনকি কিছু চিকিৎসকও। একটি কিডনি প্রতিস্থাপনে মোট ব্যয় ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা, যার বেশিরভাগই যায় দালালদের পকেটে। কিডনি বিক্রেতারা পান মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করা গবেষক ড. মনির মোনিরুজ্জামান বলেন, প্রতারণার ধরন প্রায় একই—জাল পরিচয়পত্র, ভুয়া আত্মীয়তা ও নোটারি সার্টিফিকেট। এভাবে কিডনি বাণিজ্য চলে আসছে বছরের পর বছর।
২০১৯ সালে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত শুরু করলেও কার্যকর কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০২৪ সালে দিল্লির এক চিকিৎসক গ্রেপ্তার হন, যিনি একাই ১৫ জন বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপন করেন।
ছবি: আল-জাজিরা
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এই বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এখনো কোনো কার্যকর সমন্বয় নেই। ভারতীয় হাসপাতালগুলো প্রায়ই দায় এড়িয়ে যায়।
বাইগুনি গ্রামের মানুষ এখনও স্বপ্ন দেখে ঘর বানানোর, সংসার গড়ার। কিন্তু সফিরুদ্দিনদের বাস্তবতা হলো—একটি কিডনি দিয়ে তারা হারিয়েছেন স্বাস্থ্য, স্বপ্ন ও সম্মান। তাদের একটাই আক্ষেপ—
“তারা কিডনি নিলো, আর আমাকে ফেলে চলে গেল।”
সূত্র: আলজাজিরা