মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের চলমান উত্তেজনা এখন বিশ্ব মিডিয়ার মূল ফোকাস হলেও ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা থেমে নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিবর্ষণ ও বিমান হামলায় গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৪০ জন, জানিয়েছেন স্থানীয় চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা।
গাজার অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, ইরান-ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এখন সেদিকে চলে গেছে, ফলে গাজাবাসীদের চলমান দুঃসহ পরিস্থিতি আর আলোচনায় আসছে না।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েল অবরোধ আংশিক শিথিল করার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি ঘটছে। শুধু বুধবারই ৪০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
গাজার বিভিন্ন এলাকায় চালানো হামলায় প্রাণহানি হয়েছে বহু। মাঘাজি শরণার্থী শিবির, জেইতুন অঞ্চল ও গাজা শহরের বসতিতে বোমা বর্ষণে নিহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন। খান ইউনিসের একটি শরণার্থী ক্যাম্পেও প্রাণ হারিয়েছেন ৫ জন। সালাহউদ্দিন সড়কে ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছেন আরও ১৪ জন।
এ ঘটনায় ইসরায়েলি বাহিনী (IDF) দাবি করে, ওই সড়ককে তারা আগেই ‘সক্রিয় যুদ্ধ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। গুলিবর্ষণের পেছনে তাদের ব্যাখ্যা, কিছু লোক তাদের সেনাদের দিকে এগিয়ে আসায় তা হুমকি হিসেবে মনে হয়েছে। যদিও তারা গুলি ছোঁড়ার আগে সতর্ক করেছিল বলে দাবি করে এবং আহতদের বিষয়ে নিশ্চিত নয় বলেও জানায়।
বিভিন্ন হামলার বিষয়ে আইডিএফ আরও জানায়, তারা হামাসের সামরিক অবকাঠামো ধ্বংসে কাজ করছে এবং বেসামরিক প্রাণহানি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
তবে বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসের শেষ দিক থেকে ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৪০০ জন, আহত হয়েছেন ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ।
গাজাবাসীরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মনোযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় গাজার যুদ্ধ বাস্তবতা যেন আড়ালেই পড়ে গেছে। একজন বাসিন্দা আদেল বলেন, “আমরা প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছি। এখন কেউ আমাদের খবর রাখে না। যারা খাবার সংগ্রহ করতে যায়, তারাও গুলিতে নিহত হচ্ছে। আটার বস্তা রক্তে ভিজে যাচ্ছে।”
ত্রাণ বিতরণেও শর্তারোপ ও নিয়ন্ত্রণ
ইসরায়েল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। তবে এই প্রক্রিয়াটি ইসরায়েলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত এবং অভিযোগ রয়েছে, এতে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা পৌঁছাচ্ছে না।
হামাস ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং দাবি করেছে, ইসরায়েল খাদ্য সরবরাহকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNRWA-এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, “গাজায় বর্তমান ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা আমাদের সম্মিলিত মানবিক বিবেকের জন্য লজ্জাজনক এক বিষয়।”
সহিংসতার পেছনের প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ইসরাইলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১,২০০ জনকে হত্যা এবং কয়েকশ’ জনকে অপহরণ করার পর এই যুদ্ধ শুরু হয়। জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়, যাতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়। সেই সঙ্গে অধিকাংশ বাসিন্দা ঘরছাড়া হয়েছেন এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন।
এ অবস্থায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে, যদিও দেশটি তা অস্বীকার করে আসছে।
‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধ’ গাজার বাসিন্দাদের আর্তি
গাজাবাসীরা বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার দিকেও নজর রাখছে। কারণ, বহু বছর ধরে ইরান হামাসের এক নীরব মিত্র হিসেবে সক্রিয়। তবে গাজার বাসিন্দাদের মতে, এ যুদ্ধের প্রতিটি দিন মানে আরও মৃত্যু, আরও বেদনা।
উত্তর গাজার বাসিন্দা, পাঁচ সন্তানের জনক শাবান আবেদ বলেন, “আমরা দেখলে খুশি হই যে ইরান রকেট ছুঁড়েছে। কিন্তু সেই রকেটের প্রতিক্রিয়ায় যে আমাদের ওপর আরেকটি দিন নেমে আসে, তা আমাদেরই ক্ষতি করে। আমরা চাই গাজার যুদ্ধেরও একটা পূর্ণ সমাধান হোক। দয়া করে আমাদের ভুলে যাবেন না।”
সূত্র: এই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদের তথ্যসূত্র অবলম্বনে পুনর্গঠিত ও মৌলিক ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে।